রাজধানীর আজিমপুরে বাসার উদ্দেশে ধানমন্ডি থেকে বিকাশ পরিবহনের বাসে ওঠেন এক ছাত্রী। রাত তখন পৌনে ৯টা। অনেক যাত্রী থাকা বাসের মাঝবরাবর সিটে বসেন। যান্ত্রিক নগরের কোলাহল এড়াতে কানে হেডফোন, মোবাইলে ছাড়েন গান। দিনের ক্লান্তির রেশ শরীরে, ক্ষণিকের তন্দ্রাভাবেই কারও স্পর্শ টের পান তিনি।
হুঁশ ফিরতেই চোখ মেলে পাশের সিটে আবিষ্কার করেন বাসচালকের সহকারীকে (হেলপার), যার একটি হাত নিজের হাঁটুর ওপর। মেরুদণ্ড দিয়ে ততক্ষণে হিম স্রোত বইছে! আরেকটু চোখ বুলিয়ে ভয় পেয়ে যান, পুরো বাস খালি। দরজা-জানালা ও লাইট বন্ধ। কিছু বলার আগেই হেলপার শরীরের ওপর চড়াও হয়।
এ সময় চিৎকার করে মেয়েটি চালককে বাস থামাতে বললেও কর্ণপাত করেনি; উল্টো গতি বাড়ায়। হেলপার হাত ও মুখ চেপে ধরে আওয়াজ স্তব্ধ করতে চায়। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় চলতে থাকে ধস্তাধস্তি। একপর্যায়ে লাথি মেরে হেলপারকে সরিয়ে দিয়ে দরজা খুলে লাফ দেন ছাত্রী।
ঘটনাটি ঘটেছে গত রোববার রাতে। সেদিনের সেই ঘটনা মনে হলেই শিউরে উঠছেন ছাত্রীটি। তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি ধানমন্ডিতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি করেন। সেখান থেকে ফেরার পথেই দুঃসহ্য ঘটনার মুখোমুখি হন তিনি, যা নিজের ফেসবুকে পোস্ট দেন। পরে ভুক্তভোগীর বাবা বাদী হয়ে লালবাগ থানায় মামলা করেন।
বিকাশ পরিবহনের বাসটির চালক মাহবুবুর রহমান ও তার সহকারী কাওসার আহম্মেদকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। চালককে বুধবার ও বৃহস্পতিবার সহকারীকে ঢাকার আশুলিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে লালবাগ থানা পুলিশ। জব্দ করা হয়েছে বাসটি।
পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, অভিযুক্ত চালক ও তার সহকারীকে গ্রেপ্তারের পর ছবি ভুক্তভোগীকে দেখিয়ে আসামির বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তাঁরা। কাওসারের বাড়ি পটুয়াখালী। ঘটনার পর সে পাঁচটি জেলায় আত্মগোপনে ঘুরেছে।
আশুলিয়ায় তার অবস্থান শনাক্তের পর গ্রেপ্তার করা হয়। আজ শুক্রবার আদালতে হাজির করে কাওসারের রিমান্ড আবেদন করা হতে পারে। বৃহস্পতিবার মাহবুবুরকে আদালতের মাধ্যমে এক দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ বলে জানান তিনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আসিফুজ্জামান আসিফ জানান, বৃহস্পতিবার চালক মাহবুবুরকে পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হলে বিচারক এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
লালবাগ থানার ওসি এম এম মোর্শেদ সমকালকে জানান, মামলার পরই আসামিদের গ্রেপ্তারে তাঁরা মাঠে নামেন। আশুলিয়া থেকে চালককে গ্রেপ্তার ও বাসটি (ঢাকা-মেট্রো-ব-১২-০৬০৫) জব্দ করা হয়। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহের পর পর্যালোচনা করে বাসটি শনাক্ত করা হয়।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ওই ছাত্রী বলেন, ‘নিজেকে রক্ষা করতে না পারলে বড় অঘটনা ঘটে যেতে পারত। বাসের দরজা লাগানো থাকায় বেশি ভয় পেয়েছিলাম। কীভাবে নিজেকে রক্ষা করব ভাবছিলাম, সঙ্গে চলছিল ধস্তাধস্তি। একপর্যায়ে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি, দরজায় ছিটকিনি লাগানো নেই।’
‘বাসের গতির কারণে দরজা আংশিক খুলে যাচ্ছিল। কোনো কিছু চিন্তা না করে আজিমপুর এলাকায় স্পিডব্রেকারে এসে বাসের গতি কিছুটা কমলে লাফ দিই। যে এলাকায় লাফ দিই, বিদ্যুৎ ছিল না। লোকজনও ছিল না রাস্তায়। পরে দৌড় দিই। কীভাবে লাফ দিয়েছিলেন, সেটি ভাবতেই এখন ভয় পাচ্ছেন।’ যোগ করেন তিনি।
পুলিশের লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার কুদরত-ই-খুদা বলেন, ফেসবুকে ঘটনা জানিয়ে মেয়েটি পোস্টের মাধ্যমে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। এ জন্যই দ্রুত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। অনেকেই এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়ে চেপে যান। ফলে দোষীরা অধরা থেকে যান।