নতুন এক ইতিহাস রচনা করছে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের মেয়েরা। প্রচন্ড শক্তিশালী নেপালী নারী ফুটবল দলকে আজ তাদেরই মাটিতে হারিয়ে সাফ ফুটবলের সেরার মুকুটটি মাথায় তুলে নিয়েছে। সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লাল সবুজের প্রতিনিধিরা নেপালকে হারিয়ে, তারও প্রথমবারের মতো ।
তবে ২০১৬ সালে সাবিনারা শিরোপার খুব কাছে গিয়েও স্বপ্নভঙ্গ হয় । কিন্তু ২০২২ সালে আর ভূল হয়নি, এবার আর কোনো আক্ষেপ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিতে নিয়েছে সাবিনা-সানজিদা ও মারিয়ারা।
কাঠমন্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ম্যাচটি জিতেছে ৩-১ গোলের ব্যবধানে। যা এখন সাফের নারী ফুটবলে কেবলই ইতিহাস। দলের হয়ে জোড়া গোল করেন কৃষ্ণা রানি সরকার। একটি গোল করেন শামসুন্নাহার জুনিয়র। প্রতিপক্ষের হয়ে একটি গোল শোধ করেন অনিতা বাসনেত।
ম্যাচ শুরুর প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক ফুটবল উপহার দিতে থাকে বাংলাদেশ। প্রতি আক্রমণে নেপালও হানা দিয়েছে সাবিনাদের রক্ষণভাগে। কিন্তু বৃষ্টিভেজা মাঠে পাস ঠিকঠাক না এগোনোয় উভয়পক্ষই বারবার বল হারাচ্ছিল। ম্যাচের ১০ মিনিটে সিরাত জাহান স্বপ্নাকে তুলে মাঠে নামানো হয় শামসুন্নাহার জুনিয়রকে।
মূলত আগের ম্যাচে কিছুটা চোট পাওয়ায় নেপালের বিপক্ষে মাঠে নামার পর স্বপ্নার মধ্যে ফিটনেস ঘাটতি দেখা যাচ্ছিল। যার কারণে কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন তাকে তুলে নেন। কোচের সিদ্ধান্তের প্রমাণ দিতে খুব বেশি সময় নেননি শামসুন্নাহার। ম্যাচের ১৪ মিনিটে মণিকা চাকমার বাম কর্নার থেকে পাঠানো উঁচু শট পায়ের আলতো ছোঁয়ায় জালবন্দি করেন এ তরুণ ফরোয়ার্ড।
ম্যাচের ২৪ মিনিটে প্রতিপক্ষের দূরপাল্লার শট প্রথম প্রচেষ্টায় ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হন রূপনা চাকমা। পরক্ষণেই ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্লাভসবন্দি করে দলকে বিপদমক্ত করেন বাংলাদেশের এ গোলকিপার। ২৬ মিনিটে ডি বক্সের ভিতর থেকে শামসুন্নাহারের নেয়া দুর্বল শট চলে যায় নেপালের গোলকিপারের হাতে। অবশ্য পুনামের বাধায় তিনি ঠিক ঠাক শট নিতে পারেননি।
দুই মিনিট পর ডি বক্সের বাইরে থেকে নেপাল ফরোয়ার্ড অনিতার নেয়া শট গ্লাভসবন্দি করেন রূপনা। পরের ১০ মিনিটে আরও তিনটি শট ফিরিয়ে স্বাগতিকদের হতাশ করেন রূপনা। প্রতিপক্ষের চাপ সামলে ৩৯ মিনিটে আক্রমণে ওঠে ছোটনের শিষ্যরা। তিন মিনিট পর বাংলাদেশকে ২-০ গোলের লিড এনে দেন কৃষ্ণা রানি সরকার। সাবিনার পাস নিজের দখলে নিয়ে প্রতিপক্ষের ডি বক্সে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ঢুকে পড়েন কৃষ্ণা। এরপর পেনাল্টি এরিয়া থেকে নেপাল গোলরক্ষক অঞ্জলিকে পরাস্ত করে বল জালে জড়ান তিনি।
বিরতির পর প্রতি আক্রমণে উঠে গোলের দারুণ সুযোগ নষ্ট করে নেপাল। ডান প্রান্ত থেকে অনিতার পাঠানো উঁচু শট, ডি বক্সে অরক্ষিত অবস্থায় পেয়ে যান রাশমি। কিন্তু তার হেড থাকেনি লক্ষ্যে। ৫৬ মিনিটে বাংলাদেশকে আরও একবার ডি বক্সের আক্রমণ থেকে বিপদমুক্ত করেন আঁখি খাতুন। দুই মিনিট পর সানজিদার বদলি হিসেবে মাঠে নামেন রিতুপর্ণা চাকমা।
৫৯ মিনিটে ডিফেন্ডারদের ভুলে ব্যাকপাস পেয়ে যান নেপালের ফরোয়ার্ড অনিতা। তবে তার দূরপাল্লার শট পরাস্ত করতে পারেনি রূপনাকে। তিন মিনিট পর বাম কর্নার ধরে মাঝমাঠ থেকে ক্ষিপ্র গতিতে বল নিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে ঢুকে পদেন রিতুপর্ণা। তার পাস পেনাল্টি এরিয়ায় পেলেও, গোলের জন্য শট নিতে ব্যর্থ হন শামসুন্নাহার। ছয় মিনিট পর প্রতি আক্রমণে উঠলেও, বল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি শামসুন্নাহার-রিতুপর্ণা।
একের পর এক আক্রমণে দিশেহারা সাবিনারা অবশেষে ম্যাচের ৭০ মিনিটে একটি গোল হজম করে ছোটনের শিষ্যরা। বাংলাদেশ দলের এক ডিফেন্ডারের পায়ে বল লেগে চলে যায় ডি বক্সে থাকা অনিতার কাছে। নিখুঁত শটে তিনি এবার রূপনাকে পরাস্ত করতে সফল হন। ৭৩ মিনিটে ডি বক্সের বাইরের বল ঝুঁকিমুক্ত করতে গিয়ে নিজেই ইনজুরি ঝুঁকিতে পড়েন রূপন। ৭৬ মিনিটে কৃষ্ণা নেপালের ডি বক্সের বাইরে বল পেলেও, ডিফেন্ডারদের বাধায় সুযোগ পাননি বল দখলে রেখে শট নেয়ার। পরের মিনিটে ফের আক্রমণে উঠে সে আক্ষেপ ঝাড়েন কৃষ্ণা।
মাঝ মাঠ থেকে সতীর্থে পাস ধরে ঢুকে পড়েন নেপালের ডি বক্সে। অঞ্জলির সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান আক্রমণে গোল করে বাংলাদেশের শিরোপার স্বপ্ন অনেকটা নিশ্চিত করে ফেলেন কৃষ্ণা। আসরে এনিয়ে চারটি গোল করেছেন এ ফরোয়ার্ড। বাকি সময়ে অনেক চেষ্টা করেও আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি স্বাগতিকরা। শেষ পর্যন্ত ৩-১ গোলের জয়ে ইতিহাস গড়ে মাঠ ছেড়েছেন সাবিনা-কৃষ্ণারা।
এর আগে ২০১৬ সাফের ফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ। শিলিগুড়ির সেই ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় লাল-সবুজের দলের। এতদিন পর্যন্ত নারী সাফের ইতিহাসে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য এটি। ২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া সাফের প্রতিটি আসরে খেলা বাংলাদেশ একবার রানার্স-আপ ছাড়াও ৩ বার সেমিফাইনাল এবং একবার গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নেয় । তবে এবার আর শিরোপা হাতছাড়া করেননি সাবিনা-সানজিদারা। টানা পাঁচ আসরে ভারতের আধিপত্য শেষে ষষ্ঠ আসরে এসে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট নিজেদের দখলে নিয়েছে বাংলাদেশ। আসরে সর্বোচ্চ ৮ গোল করে টুর্নামেন্ট সেরা নির্বাচিত হয়ে গোল্ডেন বুট জিতেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা খাতুন।