পৃথিবীকে শিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে তুলতে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী, গরিব নির্বিশেষে সব শিশুর ভেতর লুকায়িত পূর্ণ সম্ভাবনার উন্মেষ ঘটানোর মতো পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলেছেন তিনি। রবিবার (২৯ জানুয়ারি) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা’ – ২০২০ ও ২০২১ এর পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে তিনি এই আহ্বান জানান।
রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রতিটি শিশুর একটা ব্যক্তিত্ব আছে এবং এই ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করার সুযোগ তৈরি করে দিন। আদর, স্নেহ, ভালোবাসার পাশাপাশি শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলুন।
শিশুরা যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে অবদান রাখতে পারে, এ লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদেরকেও এগিয়ে আসার তাগিদ দেন রাষ্ট্রপতি। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে তারাই বহন করবে দেশের দায়িত্বভার। এজন্য শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
রাষ্ট্র্রপ্রধান বলেন, সৃজনশীল মেধাসম্পন্ন প্রজন্ম গড়তে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রভাব অপরিসীম। বিদ্যার্জনের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য ও ক্রীড়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিশুদের সম্পৃক্ত করে তাদের মানসিক বিকাশের পথ সুগম করা জরুরি। শুধু অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের শিশু নয়, সব স্তরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্যাণে বৈষম্যহীন মনোভাব নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের খুব ভালোবাসতেন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি হামিদ বলেন, তিনি সময় পেলেই শিশুদের সঙ্গে মিশে যেতেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিশুদের উন্নয়নে অত্যন্ত আন্তরিক।
রাষ্ট্রপতি বলেন, শিশুদের আলোকিত নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পরিবার থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সমাজের প্রত্যেকের। শিশুর মেধা বিকশিত করতে প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশে, পরিচর্যা ও অনুপ্রেরণা।
আবদুল হামিদ বলেন, দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা কোমলমতি মেধাবী শিশুদের খুঁজে এনে সঠিক প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে মানসম্পন্ন শিল্পী, আঁকিয়ে বা ক্রীড়াবীদ তৈরি করতে হবে যাতে তারা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সফলতা লাভ করতে পারে।
সরকারের নানামুখী কর্মকাণ্ডের কথা ঊল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে এবং বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির আলোকে শিশুর সার্বিক অধিকার নিশ্চিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বহুমাত্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জাতীয় কর্ম পরিকল্পনায় শিশুর স্বাস্থ্য-পুষ্টি, শিক্ষা-বিজ্ঞান প্রযুক্তি ইত্যাদিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নের জন্যও রয়েছে নানা কর্মসূচি ও পরিকল্পনা।
তিনি শিশুদের জন্য যেন গবেষণা ও চাহিদাভিত্তিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে খেয়াল রাখারও নির্দেশ দেন। কেননা এ প্রক্রিয়ায় শিশুদের মতামতেরও প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
অভিভাবকদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, শিশুদের সঠিক শিক্ষা, যেমন ন্যায়-নীতি, সত্য-মিথ্যার বিভেদ, সততা, দয়া, দেশপ্রেম, জীবপ্রেম ইত্যাদি প্রদানের মূল কাজ আপনাদের। বর্তমান বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে শিশুদের নৈতিক শিক্ষা প্রদানের প্রতিও গুরুত্বারোপ করেন রাষ্ট্রপতি।
তিনি বলেন, এখন প্রত্যেক ঘরে ঘরে শিশুদের হাতে মোবাইল, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক ডিভাইস। ফলে শিশুরা আজ মোবাইলে আসক্ত। তারা খেলার মাঠে বেশি যায় না, শিল্প-সাহিত্য চর্চা করে না, প্রকৃতি-পরিবেশ চেনে না। তিনি প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিক থেকে সন্তানদের রক্ষা করে নিয়মিত লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুদের সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত করতে অভিভাবকদের প্রতিও অনুরোধ করেন।
শিশুদের উপদেশ দিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশকে ভালোবাসতে হবে, দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে উন্নত, সমৃদ্ধ, আধুনিক ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে তোমরা সবসময় সচেষ্ট থাকবে।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ২০২০ এবং ২০২১ সালের জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ শিশু অংশ নেয়। ৩০টি বিষয়ে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ৪৭৪ জন শিশু অংশ নেয় পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে। ২০২২ সালে ছয় জন ও ২০২১ সালের ছয় জন, মোট ১২ জন রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নেয়।
অনুষ্ঠানে শিশুর উন্নয়ন, বিকাশ ও সুরক্ষা বিষয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র ও প্রদর্শন করা হয়। এ উপলক্ষে স্মারক গ্রন্থ ‘আলোর ফুল’ প্রকাশিত হয়।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা এমপির সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লাকী ইনাম এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল প্রমুখ।