র্যাব হেফাজতে মারা যাওয়া নওগাঁ সদরের ভূমি অফিসের কর্মী সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে যুগ্ম সচিব এনামুল হক বাদী হয়ে যে মামলাটি করেছেন সেটির এজাহার ও তার বক্তব্যে ব্যাপক অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। এছাড়া রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকের বক্তব্য ও র্যাবের দাবির মধ্যেও বিস্তর ফারাক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অফিসের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক এনামুল হকের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় সুলতানা জেসমিন দুই নম্বর আসামি। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে চাঁদপুর জেলার হাইমচরের আল আমিনকে। এনামুল হক যখন রাজশাহী মেট্রিপলিটন পুলিশের রাজপাড়া থানায় মামলার এজাহার পাঠিয়ে মামলাটি রেকর্ডের জন্য আরএমপির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে তদবির করেন, ঠিক সেই সময় সুলতানা জেসমিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন। জেসমিনের মুমূর্ষ মুহূর্তে দায়ের করা মামলায় বাদী উল্লেখ করেছেন, র্যাব কর্মকর্তাদের সহায়তায় তিনি থানায় মামলা করেছেন। একজন সরকারি চাকরিজীবীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের আগে সরকারি অনুমোদন বা কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এনামুল হক রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অথবা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে মামলা দায়েরের জন্য পুর্বানুমতি নেননি বলে জানা গেছে।
এদিকে সুলতানা জেসমিনকে তুলে নেওয়া সংক্রান্ত র্যাবের দেওয়া বক্তব্য ও যুগ্ম-সচিব এনামুল হকের মামলার এজাহারে দেওয়া বক্তব্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা গেছে। এনামুল হক মামলার এজাহারে বলেছেন, ২২ মার্চ বেলা সোয়া ১১ টার দিকে দাপ্তরিক কাজে তিনি নওগাঁয় যান। ওই সময় শহরের বাসস্ট্যান্ড মোড়ে র্যাবের একটি টহল দলকে তিনি দেখতে পান। র্যাব টিমের ইনচার্জ উপ-সহকারি পরিচালক (ডিএডি) মো. মাসুদকে তিনি ঘটনাটি জানান। এরপর বেলা ১১ টা ৫৫ মিনিটে সুলতানা জেসমিনের অবস্থান শনাক্ত করে তাকে আটক করে নিয়ে যায় র্যাবের দল।
এনামুল হক তার এজাহারে আরও বলেছেন, সুলতানা জেসমিনের কাছ থেকে র্যাব একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করে। এতে প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে। তিনি জানতে পারেন র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদের সময় জেসমিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সুলতানা জেসমিনের শারীরিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এই বিষয়ে থানায় মামলা করতে তার দেরি হয়েছে। তার নামে ফেসবুক আইডি খুলে প্রতারণা হচ্ছে এই বিষয়টি তিনি বরিশালের আরিফ নামের একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে প্রথমে জানতে পারেন। সেই সূত্রে তিনি র্যাবকে ঘটনা জানিয়েছিলেন। তিনি সুলতানা জেসমিনকে আগে চিনতেন না। কোনো যোগাযোগও ছিল না।
এদিকে র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের অস্বাভাবিক মৃত্যু ও ঘটনার নেপথ্যে তারই যোগসূত্র আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার জানতে চাইলে যুগ্ম-সচিব এনামুল হক বলেন, ফেসবুকে আমার আইডিটি ছিল ব্যক্তিগত। তিনি আগে কোনদিন সুলতানা জেসমিনকে দেখেননি বা কোনো পরিচয় ছিল না। তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে বিষয়টি তিনি বেশ কিছুদিন আগেই জানতে পারেন। ওই সময় রাজপাড়া থানায় একটি জিডি করেছিলেন। বিষয়টি আগেই র্যাবকে জানানো হয়েছিল। র্যাব তদন্ত করে সুলতানা জেসমিনের ব্যাংক হিসেবে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পায়। র্যাবই সুলতানা জেসমিনের অবস্থান ও পরিচয় শনাক্ত করেন। চাঁদপুরের হ্যাকার আল আমিনের সঙ্গে সুলতানা জেসমিনের গোপন লেনদেনের বিষয়ে র্যাব আগেই বিস্তারিত তথ্য উদঘাটন করে। তবে এ ঘটনায় যুগ্ম সচিব আগে একটা জিডি করেছিলেন। কবে কোথায় জিডি করেছিলেন জানতে চাইলে এনামুল হক কোনো জবাব দিতে পারেননি।
অন্যদিকে মামলা এজাহারে আকস্মিকভাবে নওগাঁ বাসস্ট্যান্ডে র্যাব টিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও তাদেরকে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত করার কথা কেন এজাহারে লিখেছেন—জানতে চাইলে এনামুল হক বলেন, র্যাব আগে থেকেই আমার অভিযোগটি তদন্ত করছিল। তারা আগেই সব ঘটনা জানত। আমি ঘটনার দিন দাপ্তরিক কাজে নওগাঁতে গিয়ে ঘটনাক্রমে র্যাবের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। তখন তাদেরকে বিষয়টি বলি। তারা সুলতানা জেসমিনকে আটক করেন।
তবে সুলতানা জেসমিনকে আটকের বিষয়ে তিনি জড়িত নন বলে দাবি করেন এনামুল হক। তিনি শুধু র্যাবকে বিষয়টি দেখতে বলেছিলেন। তুলে নিতে বলেননি। তবে র্যাব মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মুঈন মঙ্গলবার ঢাকায় যে ব্রিফিং করেছেন তাতে স্পষ্ট করে বলেছেন, যুগ্ম সচিবের উপস্থিতিতে সুলতানা জেসমিনকে গ্রেফতার করা হয়।
এনামুল হক আরও বলেন, গত ১৯ মার্চ সুলতানা জেসমিনসহ আসামিরা রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অফিসের নিচে তার নামে অবৈধ লেনদেন করেন বলে তার অফিস সহকারি জামালের দেওয়া তথ্যে তিনি জানতে পারেন। তবে নওগাঁর চন্ডিপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারি ভূমি কর্মকর্তা কাজী রাফিউল ইসলাম জানিয়েছেন, গত ১৯ মার্চ সুলতানা জেসমিন নির্ধারিত দাপ্তরিক সময়ে অফিসে উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন রাজশাহী যাওয়ার বা অন্য কোথাও যাওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়।
অন্যদিকে র্যাবের গণমাধ্যম শাখা সুলতানা জেসমিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে দাবি করলেও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহাম্মেদ মস্তিস্কে রক্তক্ষরণে তার মৃত্যুর কথা জানিয়েছেন। সুলতানা জেসমিনের মাথায় একটি ছোট আঘাতের চিহ্ন ছিল বলেও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন;যদিও র্যাব দাবি করেছেন, এ বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। রামেক ফরেনসিক বিভাগের ময়না তদন্ত টিমের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সুলতানা জেসমিনের মাথায় ছোট কাটা ফুলা একটি লাল দাগ ছিল। ডান হাতের একটি জায়গাতেও রক্তজমা কালশিরা ছিল। এই চিহ্নগুলো বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার কোনো চিহ্ন কিনা-এ নিয়ে তারা সন্দিহান। যেহেতু মৃতদেহের সুরতহাল করেছেন রাজশাহী জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট। বিষয়টি সুরতহাল প্রতিবেদনে এই বিষয়টি উল্লেখ নেই। সুরতহালকারী কর্মকর্তা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।
এদিকে সুলতানা জেসমিনের ময়না তদন্তকারী তিন সদস্যের প্রধান রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা. কফিল উদ্দিন বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা বলতে পারি সুলতানা জেসমিন মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের কারণে মারা গেছেন। তিনি আরও বলেন, সুলতানা জেসমিনের মস্তিস্কে মাল্টিপল ইনজ্যুরি বা হেমারেজ হয়। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি আরও জানান, সাধারণভাবে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হলে এক ধরণের ব্রেইন হেমারেজ হয়। অন্যদিকে গুরুতর আঘাতজনিত কারণে রক্তক্ষরণ হলে মাল্টিপল ইনজ্যুরি হয় মস্তিস্কে। সুলতানার ক্ষেত্রে ব্রেইনে মাল্টিপল ইনজুরির ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে অভিযোগকারী যুগ্ম-সচিব এনামুল হকের বিষয়ে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। একটি সরকারি সূত্রে জানা গেছে, চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার অভিযোগে গত বছর অক্টোবরে এনামুল হকের বিরুদ্ধে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় একটি প্রতারণার মামলা হয়। এক নারী বাদী হয়ে মামলাটি করেছিলেন। এই মামলায় এনামুল হক জামিনে আছেন। নিয়মিত আদালতে হাজিরাও দেন তিনি। তবে এনামুল এই বিষয়ে কিছু বলতে অস্বীকার করেন।
এদিকে সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে দায়ের করা ডিজিটাল আইনের মামলার বাদী আরএমপির রাজপাড়া থানার এসআই সুভাষ চন্দ্র বর্মণ বলেন, উনি একটি এজাহার দিয়েছিলেন সেটি মামলা আকারে রেকর্ড করা হয়। মামলাটি তিনি তদন্ত করছেন। এই বিষয়ে বর্তমানে তিনি বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।