জাতীয়

ক্ষমতার অপব্যবহারে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার মান নিম্নগামী : টিআইবি

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যানের একচ্ছত্র ক্ষমতা, রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনাসহ হাসপাতাল পরিচালনায় বিবিধ দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। ফলে চিকিৎসা সেবার মান নিম্নগামী এবং সুনাম নষ্ট হওয়ার কারণে রোগীর পরিমাণ ও হাসপাতালের আয় হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি ক্রমেই একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

রোববার (২৫ জুন) প্রকাশিত ‘হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, হাসপাতালটিতে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মূলনীতির পরিপন্থী কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটির সুনাম বিনষ্ট করছে।

হাসপাতালটির সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে ১৪ দফা সুপারিশও করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান।

প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন টিআইবির সাবেক গবেষক ও বর্তমানে পরামর্শক তাসলিমা আক্তার এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মো: মাহ্ফুজুল হক। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গুণগত পদ্ধতি ব্যবহার করে এপ্রিল ২০২২ থেকে মে ২০২৩ পর্যন্ত সময়কালে গবেণষণার তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পরিমাণগত তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ, তথ্য প্রকাশ ব্যবস্থা, নথিপত্র প্রভৃতি বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে গবেষণাভুক্ত বিষয়সমূহকে সুশাসনের নির্দেশকের (সক্ষমতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি) আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গবেষণায় হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের বিভিন্ন আইনি দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। যথাযথ আইন ও বিধিমালা না থাকায়, বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিডিআরসিএসের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ট্রেজারার ও ক্ষমতাসীন দলীয় রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কমিটিতে প্রাধান্য পেয়েছে এবং হাসপাতাল পরিচালনা, নিয়োগ, বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, অনুদানের অর্থের আয়-ব্যয়সহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় বিডিআরসিএস চেয়ারম্যানকে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

তাছাড়া, হাসপাতালের জন্য আলাদা মানবসম্পদ কাঠামো এবং আর্গানোগ্রামও নেই। ফলে অপরিকল্পিত নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিসহ হাসপাতালের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

হাসপাতালের লাইসেন্স নিয়মিত নবায়ন না করা, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যবস্থাপনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের নির্বাচন করা ও চেয়ারম্যানের কথামতো কাজ না করায় হাসপাতাল পরিচালকের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি, হাসপাতালে জনবল নিয়োগ, পদায়নে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত পছন্দ ও দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য দেয়া হয়।

ডাক্তার নিয়োগে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। চাকরিপ্রার্থীদের কাছে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ চাওয়ারও অভিযোগ উঠে এসেছে গবেষণায়। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগের ফলে প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অথচ হাসপাতালের প্রাত্যহিক চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনায় চিকিৎসক, নার্স, নিজস্ব পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ প্রয়োজনীয় জনবলের ঘাটতি রয়েছে।

গবেষণায় আরো দেখা যায়, হাসপাতালের আর্থিক সামর্থ্যে ঘাটতি রয়েছে এবং আয় বৃদ্ধিতে যথাযথ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ। উল্টো হাসপাতালের ২০ শয্যার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডায়ালাইসিস সেন্টার থাকা সত্ত্বেও বিতর্কিত জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে হাসপাতালে একটি বিশেষায়িত ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করা হয়। এমনকি জেএমআইকে সুবিধা দিতে হাসপাতালের নিজস্ব মেশিন অকেজো রাখার অভিযোগ রয়েছে।

অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা হাসপাতালের বাইরে প্রাইভেট চেম্বার করেন বলে জানা গেছে গবেষণায়। ইন্টার্ন ডাক্তারের মাধ্যমে রোগীকে চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ভিজিটিং কার্ড প্রদান করেন। হাসপাতাল প্রদত্ত পরীক্ষার প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সন্দেহ দূর করা এবং নিশ্চিত হয়ে সেবা প্রদানের অজুহাতে রোগীকে হাসপাতালের বাইরের প্রতিষ্ঠান থেকে প্যাথলজি পরীক্ষা ও আলট্রাসনোগ্রাম করানোর পরামর্শ দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

হাসপাতালের লাইসেন্স নিয়মিত নবায়ন না করা, ক্রয় আইন, তথ্য অধিকার আইন ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) সংক্রান্ত আইন ও বিধান অমান্য করলেও সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়নি। বিশেষ করে, হাসপাতালে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ, সংরক্ষণ ও প্রচার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গুরুত্ব পায়নি। ফলে হাসপাতাল সংক্রান্ত তথ্যের স্বচ্ছতার ঘাটতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

ক্রয়-প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। নির্দিষ্ট সীমা বা তিন লাখ টাকার বেশি ক্রয়ে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে প্রাইস কোটেশন পদ্ধতি অনুসরণ, একইব্যক্তি থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রাইস কোটেশন সংগ্রহ ও পছন্দের ব্যক্তিকে কাজ প্রদান করা হয়েছে। একইসাথে, একটি মানবিক সহায়তা সংস্থা হলেও হাসপাতালটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকার কর্তৃক অনুদান এবং আয় ও ব্যয়ের হিসাব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে নথিভুক্ত ও নিরীক্ষার আওতায় আনেনি, যা অংশীজনদের আস্থার সংকট তৈরি করেছে।

অন্যদিকে, হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর চিকিৎসায় সকল ওষুধ না লাগা সত্ত্বেও কখনও কখনও বিল পরিশোধ করানো এবং ক্ষেত্রবিশেষে রোগীর ওষুধ চুরি হওয়ার ঘটনার অভিযোগও উঠে এসেছে গবেষণায়। একইসাথে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অসম চুক্তিসহ বিবিধ দুর্নীতির কারণে চিকিৎসা সেবার মান নিম্নগামী ও সুনাম নষ্ট হওয়ায় রোগীর পরিমাণ ও হাসপাতালের আয় হ্রাস পেয়েছে।

গবেষণায় বিবেচিত সুশাসনের পাঁচটি নির্দেশকেই যে ব্যাপক ঘাটতি দেখা গেছে, তা এমন ঐতিহ্যবাহী হাসপাতালের ক্ষেত্রে হতাশাজনক উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এক ব্যক্তির হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকায় এবং হাসপাতাল পরিচালনায় একক কর্তৃত্বের অবারিত প্রয়োগের ফলে সেবা প্রদানসহ সার্বিক কার্যক্রমে একদিকে সংশ্লিষ্ট আইন ও নিয়মনীতির যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না ও অন্যদিকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিহীনতা স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগত পছন্দ ও দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ, পদায়ন থেকে শুরু করে ক্রয়খাতসহ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের যে সুনাম ছিল, তা ব্যাপকভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। অন্য হাসপাতালের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে ক্রমেই হাসপাতালটি একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।’

‘হাসপাতালটি সুশাসনের ঘাটতির দীর্ঘ পরিক্রমায় আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের মূলনীতি পরিপন্থী চর্চায় জর্জরিত। এ অবস্থার জন্য সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও অংশীজনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। এই সুশাসনের ঘাটতি থেকে উত্তরণে সবার আগে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। একইসাথে ব্যবস্থাপনা অবকাঠামোর মূলধারায় সুশাসনের মৌলিক উপাদানসমূহ অন্তর্ভুক্ত করে ঢেলে সাজাতে হবে।’

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে ১৪ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি অর্ডার, ১৯৭৩ বা প্রেসিডেন্ট’স অর্ডার নং ২৬, ১৯৭৩ সংশোধন করে চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা হ্রাস এবং সকল আয়-ব্যয় ও কর্মকাণ্ড বোর্ড সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরিচালনা; হাসপাতালের জন্য একটি কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত মানবসম্পদ কাঠামো/আর্গানোগ্রাম তৈরি করা; একটি আলাদা বিধিমালার প্রণয়ন করে হাসপাতালটির ডাক্তার/নার্স/টেকনিশিয়ান/কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকল স্তরের কর্মী নিয়োগ, পদোন্নতি, সুযোগ-সুবিধা ও দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; হাসপাতালটির সুনাম পুনরুদ্ধার এবং হাসপাতালে সেবার মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন ও অবকাঠামো মেরামতে কার্যকর পদেক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি। প্রেস বিজ্ঞপ্তি।