রাজনীতি

নির্বাচন ঘিরে বড় সিদ্ধান্ত বিএনপির

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান আজ শুক্রবার জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন ঘিরে বড় সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। বেলা ১১টায় তার গুলশানের বাসায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন তিনি এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

এ সময় লিখিত বক্তব্যে ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘৭ জানুয়ারির একতরফা ও ভাগ-বাঁটোয়ারার যে নির্বাচনকে নিয়ে দেশে-বিদেশে হাস্যরস ও সমালোচনা চলছে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার নিজ দায়িত্বে ও মরিয়া উদ্যোগে, প্রতিদিন সেটিকে প্রহসন ও সহিংসতার নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। ডামি প্রার্থী ও ডামি দল উৎপাদন করেই ক্ষান্ত হয়নি, এখন তারা নজর দিয়েছে জোরপূর্বক ডামি ভোটার সৃষ্টিতে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও ৬২টি গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি, তথাকথিত নির্বাচনকে একযোগে বর্জন ও প্রত্যাখ্যান করেছেন দেশের সকল শ্রেণী ও পেশার ভোটার, প্রতিটি বিবেকবান ও সচেতন নাগরিক। দিশেহারা হয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে, বানরের পিঠা ভাগাভাগির এই ধিকৃত আয়োজনকে, অবৈধ সরকার ‘অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন’ হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে। তাই আওয়ামী লীগ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের চিহ্নিত অংশ মিলে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরী করেছে।’

মঈন খান আরও বলেন, ‘জনগণের আকাঙ্খার বিপরীতে অনুষ্ঠিতব্য অর্থহীন নির্বাচনে, কৃত্তিম ভোটার উপস্থিতি দেখাতে, জনবিছিন্ন সরকার যেভাবে সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছে, তা নৈতিকভাবে গণবিরোধী ও রাজনৈতিকভাবে শিশুসুলভ। তাদের পরিকল্পিত অপপ্রয়াসে কেবল বাংলাদেশের ভাবমূর্তিই ক্ষুন্ন হচ্ছে না, নির্বাচন নামের অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বিষয়টি হয়ে উঠেছে শোষকগোষ্ঠীর নির্লজ্জতা ও দেউলিয়াত্বের প্রতীক। ভোটার সংখ্যা বাড়িয়ে দেখাতে তাদের সকল অপকৌশলের ফিরিস্তি আজ আন্তর্জাতিক অংশীজনদের কাছে সুস্পষ্ট যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদে।’

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘মিথ্যা ও প্রতারণামূলক ভোটার উপস্থিতি উপস্থাপনের লক্ষ্যে, আওয়ামী লীগ ও আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রযন্ত্র অজস্র অনৈতিক, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক উদ্যোগ নিয়েছে, যার মাঝে নির্বাচিত ১০টি উদাহরণ আমরা আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।’

(১) অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্যি, পাতানো নির্বাচনে কিছুটা বৈধতা অর্জনের খায়েশে, সমাজের খেটে খাওয়া ও তৃণমূল জনগোষ্ঠীর ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অপচেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। নিশিরাতের এমপিরা দেশ জুড়ে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছেন ভোট কেন্দ্রে না গেলে লক্ষ-লক্ষ সুবিধাভোগী মানুষ তাঁদের আর্থিক সুবিধা হারাবেন। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ২৮ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন সামাজিক সুবিধা পাচ্ছেন, যা যুগের পর যুগ ধরে, সকল সরকারের অধীনে একটি চলমান প্রক্রিয়া। এসব সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়া নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধানে এলাকায়-এলাকায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, ৭ জানুয়ারী ভোট না দিলে তাঁদের ভাতা বাতিল করে দিবে।

(২) জবরদস্তিমূলক কৌশলে অনেক জায়গায় সরকারি ভাতাভোগীদের কার্ড জব্দ শুরু করেছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। ভোট কেন্দ্রে গিয়ে জনসম্মুক্ষে ভোট না দিলে, সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা তাঁদের কার্ড আর ফেরত পাবেন না বলে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।

(৩) এমনকি সরকারের স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ধরনের ভাতাভোগীকে ভোট প্রদানে বাধ্য করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বয়স্ক ভাতাভোগী প্রায় ৭০ লক্ষ এবং বিধবা ভাতাভোগী প্রায় ৩০ লক্ষ, অর্থাৎ এক কোটি ভোটারকে প্রশাসনের যোগসাজসে কেন্দ্রে উপস্থিত করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার।

(৪) নজিরবিহীন এক অপকৌশলে, সারা দেশের প্রায় ২০ লক্ষ সরকারি চাকরিজীবীদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ানোর প্রশাসনিক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তে প্রশাসনের বিশাল অংশ জুড়ে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের ভোটাধিকার নিয়ন্ত্রণের এই অপপ্রয়াস নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে দেশে-বিদেশে গুরুতর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

(৫) নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নেবেন, এমন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোস্টাল ভোট গ্রহণের উপর জোর দিয়েছে অবৈধ সরকার ও তার দলদাস রাষ্ট্রযন্ত্র। একইসঙ্গে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে বলা হচ্ছে। এর বাইরে প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারসহ বিভিন্ন নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেন লক্ষাধিক বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। এবার তাদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে বলা হচ্ছে।

(৬) তথাকথিত নির্বাচনের দিন আনসার ভিডিপির ৬১ লাখ সদস্যের বড় অংশ নানাবিধ দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁদের সবার পোস্টাল ভোট নিশ্চিত করা এবং প্রত্যেকের পরিবারের অন্তত পাঁচ জন করে সদস্যদের কেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়ে প্রতিটি ইউনিট ও ব্যাটালিয়নে চিঠি দিয়েছে সদরদপ্তর। চিঠিতে প্রতিটি সদস্যের তথ্যও চাওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এই অপব্যবহার যেন ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের দলীয়করণের এক নির্বাচনী উদাহরণ।

(৭) দেশ জুড়ে পুলিশ সদস্যরা ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ানোর মিশনে নেমে পড়েছে। খোদ ঢাকার পুলিশ কমিশনার দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের ডেকে নিয়ে ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি যথাসম্ভব নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের এসপি-ওসিরা সরাসরি যুক্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রচারণায়, আহবান করছেন ভোট প্রদানে। জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর রাজনৈতিক দায়িত্ব পুলিশকে কে বা কারা দিয়েছে? এই পক্ষপাতদুষ্ট ও দলীয় আচরণের সাংবিধানিক ও আইনি ভিত্তি কি?

(৮) ভোট দিতে না গেলে জাতীয় আইডি কার্ড বাতিল করা হবে, এমন হুমকিও দিচ্ছে কোনো-কোনো আওয়ামী লীগ নেতা। আবার তাদের কিছু দুষ্কৃতিকারী বলছে ভোট না দিলে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, নৌকায় ভোট না দিলে মসজিদে নামাজ পড়তে দেওয়া হবে না কিংবা কবরস্থানে কবর দিতে দেওয়া হবে না ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল এমন ঘৃণ্য বক্তব্যও দিচ্ছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা।

(৯) আওয়ামী লীগের রাজনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় কালো টাকার দৌরাত্ন। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নে নিমজ্জিত দলটির কোনো-কোনো নেতা ঘোষণা দিয়েছে, ভোটার আনতে পারলে লাখ টাকার পুরস্কার দেওয়া হবে। স্বাভাবিকভাবেই, এর প্রভাবে দলীয় কর্মীদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ আরও গতিশীল হয়েছে। বেড়েছে ভোটারদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং ভোটার জড়ো করার নামে স্থানীয় ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজি। সমাজের ছিন্নমূল-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কিছু কাঁচা টাকা দিয়ে ভোটের লাইনে দাঁড় করাবার সাংগঠনিক অপপ্রয়াসে আওয়ামী লীগ লিপ্ত হলেও সেটি ব্যর্থ হতে যাচ্ছে বলে সামাজিক গণমাধ্যমে খেটে খাওয়া মানুষদের নানা সংক্ষুব্ধ ভিডিও থেকে আমরা দেখতে পাই।

(১০) ভোট কারচুপি ও ভোট ডাকাতির যে ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে স্থাপন করেছে ২০২৪ সালে তার পুনরাবৃত্তি ঘটার সকল আলামত স্পষ্ট। আমরা জানতে পেরেছি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে এবারও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা লাগামহীন জাল ভোট দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। আশংকা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, ভোটার সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর স্বার্থে, নিজেদের ঐতিহ্য মোতাবেক, তারা অজস্র মৃত ও প্রবাসী ব্যক্তির নামে নিজ দায়িত্বে ভোট দিয়ে দিবে। অর্থহীন এক উপনির্বাচনে ৫৩ সেকেন্ডে ৪৭ ভুয়া ভোটের যে বিশ্ব রেকর্ড তারা সৃষ্টি করেছে সেই ধারাবাহিকতায় ৭ জানুয়ারী যে আরও ভয়ঙ্কর ও কলঙ্কিত নির্বাচনী অনিয়ম ঘটাতে যাচ্ছে তা সর্বমহলে বোধগম্য।

তিনি বলেন, ‘বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করার হুমকি দেওয়া, ভাতা কার্ডধারী অসহায় মানুষের জীবন-জীবিকাকে সংকটে ফেলা, কিংবা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় ভূমিকায় অবতীর্ন করা এর প্রত্যেকটিই আইনগত অপরাধ। বিশেষত যাঁরা রাষ্ট্রীয় ভাতা পাচ্ছেন, তাঁরা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে এসব সরকারি সুবিধা পাচ্ছেন। কোনো ব্যক্তি, পরিবার কিংবা দলের পক্ষ থেকে এটি কোনো অনুদান নয়। অতএব, ভাতা কার্ড বা সরকারি সুবিধার বিনিময়ে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধ্য নন। ভোট কেন্দ্রে যাওয়া বা না যাওয়া, নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা বর্জন করা, সকল সিদ্ধান্তই প্রতিটি সম্মানিত ভোটারের গণতান্ত্রিক অধিকার।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, ‘সুতরাং, আমরা গণতন্ত্রকামী জনগণের প্রতি আহবান জানাবো, আপনারা এই অবৈধ সরকারের হুমকি- ধামকি সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করুন। যে বা যারা আপনাকে ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধ্য করছে তাদের নাম সংরক্ষন করে রাখুন। ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় ফুরিয়ে আসছে, তাই তাদের অন্যায় ও অবৈধ হুমকিকে পরোয়া করবার কোনো কারণ নেই। আমরা দ্যার্থহীনভাবে জানাতে চাই, ভাতা কার্ড জব্দ করে কিংবা ভাতা না দেওয়ার হুমকি দিয়ে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধ্য করার মতো অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত, ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক সরকার অবশ্যই তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সর্বজনীন ভোট বর্জনের মাধ্যমে, চলমান আন্দোলনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও অংশগ্রহণে ফ্যাসিবাদের কবল থেকে বাংলাদেশ শীঘ্রই মুক্ত হবে, ইনশাআল্লাহ।’