রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক নারীর ছেলেকে দরজা বন্ধ করে বেধড়ক পিটিয়েছেন একদল ইন্টার্ন চিকিৎসক। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতালের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কক্ষে এ ঘটনা ঘটে।
প্রচণ্ড মারধরে সুমন পারভেজ রিপন নামের ওই যুবক ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বলতে থাকেন- আমাকে আর মাইরেন না ভাই। আমি এ কথা কাউকে বলব না। কোথাও কোনো অভিযোগ করব না।
রিপনের মা পিয়ারা বেগম (৬০) গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। তার বাড়ি রাজশাহী মহানগরীর বোসপাড়া এলাকায়। সামান্য বাগবিতণ্ডার জেরে হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা রিপনকে দুই দফা মারধর করেন। মারধরের সময় ইন্টার্ন চিকিৎসকরা তাকে অত্যন্ত অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন এবং রিপনের মাথা ন্যাড়া করে দিতে চান। এছাড়া সন্ত্রাসীদের মতো রিপনের হাতও কেটে দিতে চান ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। সুমনকে মারধরের ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। উঠেছে নিন্দার ঝড়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বেলা ১১টার দিকে রিপন বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে ইন্টার্ন চিকিৎসকের কাছে তার মায়ের চিকিৎসার খোঁজখবর নিতে যান। এ রিপোর্ট দেখার সময় ইন্টার্ন চিকিৎসকের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় রিপনকে কৌশলে ডেকে একদফা মারধর করা হয়। এরপর একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক এলে রিপন তাকে ঘটনার বিষয়ে জানাতে যান। তখন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকের সামনেই দ্বিতীয় দফায় রিপনকে মারধর করা হয়। পরে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে নিয়ে যান। রিপনের বক্তব্য শোনার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এদিকে দ্বিতীয় দফায় মারধরের ঘটনা ফাঁস হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, রিপন বলছেন যে তাকে ডেকে এনে মারধর করা হয়েছে। তখন একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক রিপনকে শাসিয়ে বলেন, ‘কেন মারল সেই কথা বল।’ এ সময় একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক রিপনের টুপি খোলার নির্দেশ দেন এবং চড়থাপ্পড় মারতে শুরু করেন। তখন রিপন বলতে থাকেন, ‘ভাই মাইরেন না আর।’ ‘ও মা’ ‘ও মা’ বলে চিৎকার করতে থাকেন তিনি।
এ সময় একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘মারতে মারতে তোকে শেষ করে দিব। চিনিস তুই আমাদেরকে? চোখ-কান ফাটাবি তুই?’ রিপন বলতে থাকেন- ‘মাফ চাই ভাই, আর মাইরেন না ভাই।’
তখন একজন ইন্টার্ন বলেন, ‘এই ওর চুলডা খোলেন। ন্যাড়া করে দিই।’ তখন রিপন বলেন, ‘স্যার আমাকে বাহির করে দেন স্যার।’ তখন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘এই তুই বের হবি কেন? তুই না ডাক্তার দেখবি? দ্যাখ।’ রিপন বলতে থাকেন, ‘আমার আম্মু মইরে যাবে স্যার। এ রকম করিয়েন না।’ ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘তোর মা মরবে কি না সেটা আমরা দেখব।’
এরপর আবার মারধর শুরু হয়। রিপন চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘ও হাত ভেঙে গেল, হাত ভেঙে গেল। ও মা….ও মা…।’ এ সময় একজন চিকিৎসক ‘থাক’ ‘থাক’ বলে থামানোর চেষ্টা করলেও মারধর চলতে থাকে। একজন বলে ওঠেন, ‘এই তুই হাত দিতে চাইছিলি না? হাত কাইটা রাইখা দিই?’ রিপন বলেন, ‘আমি মারিনি কাউকে।’ তখন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘এই তুই মারার চেয়ে বড় কিছু করেছিস।’ মারের চোটে এবার রিপন বলে ওঠেন, ‘আমি মরে যাব স্যার, একটু পানি দেন পানি।’
এ সময় জ্যেষ্ঠ চিকিৎসককে ডেকে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘স্যার আপনার পা দেন তো, এই তুই মাফ চা।’
রিপন আবার হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে থাকেন, ‘স্যার একটু পানি দিবেন প্লিজ। ও আমার মাথা ঘুরছে।’ এ সময় একজন নার্স এসে পানি দেন। তখন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘মুখ ধো, পানি খাবি না।’ তখন আরেকজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘আমাকে বলেছে জুম্মায় জুম্মায় আট দিন বয়স হয়েছে। ওর চোখ, কান মুখ আমি ফাটিয়ে দেব।’ তখন রিপন এ কথার প্রতিবাদ করে বলেন, ‘আমি এই কথা আপনাকে বলিনি স্যার। তুই আবার কথা বলিস? কাকে বলেছিস বল।’
এ সময় রিপন বলেন, ‘আমি কাউকে বলব না। আমাকে বের করে দেন স্যার।’ ইন্টার্ন চিকিৎসক তখন বলেন, ‘আমরা ভয় পাই নাকি তোকে? কাকে বলবি বল।’ রিপন বলেন, ‘আপনারা আমাকে ছেড়ে দেন। আমার আম্মা জানলে অসুস্থ হয়ে যাবে। আমার আম্মাকে বইলেন না প্লিজ। আমার আম্মাকে নিয়ে খুব টেনশনে আছি স্যার। আমাকে যা মেরেছেন, আমার আম্মাকে বইলেন না।’
একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘তোমার আম্মাকে বলব না। কিন্তু তোমার ব্যবস্থা করতে হবে।’ রিপন বলেন, ‘ব্যবস্থা তো করলেন স্যার।’ ইন্টার্ন বলেন, ‘করলাম তো। এখন ডিরেক্টর স্যারের কাছে নিয়ে যাব।’ রিপন বলেন, ‘নিয়ে চলেন। কিন্তু আম্মাকে বুঝতে দিয়েন না স্যার।’ এ পর্যায়ে রিপনকে ‘পানি খাও’ বলে পানি খেতে দেওয়া হয়।
তখনো মারধর শুরু হলে রিপন আবার বলতে থাকেন, ‘আর মাইরেন না স্যার। হাতজোড় করছি স্যার। অনেক মেরেছেন।’ এ সময় রিপনের নাম-ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়। রিপনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি এটা নিয়ে কখনোই কোনো কথা বলব না। কোনো অভিযোগ করব না।’
পরে হাসপাতালে দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যরা গিয়ে রিপনকে উদ্ধার করে হাসপাতাল পরিচালকের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে রিপন তার সারা শরীরে মারধরের দগদগে চিহ্ন দেখান। রিপনকে হাসপাতালে এমন নির্মমভাবে নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন অনেকেই। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছে।
রামেক হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে নানা সময় কর্মসূচি পালন করা সামাজিক সংগঠন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘হাসপাতালে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিছু সামনে আসে, বেশিরভাগই আসে না। হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার প্রতিবাদ করায় তার ছেলেকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করার ঘটনাও ঘটেছে। এবার এ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, আমরা অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার চাই। তা না হলে রাজশাহীর মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমরা মাঠে নামব।’
জানতে চাইলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে শেখার জন্য পাঠানো হয়েছে। ডাক্তারি করার তাদের লাইসেন্সও আছে। এমন ঘটনা তারা ঘটালে লাইসেন্সও বাতিল হতে পারে। যদিও আসলে কী ঘটেছে তা আমি জানি না।’
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএফএম শামীম আহমদ বলেন, ‘এই ছেলে ডাক্তারদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল। ডাক্তাররা তার বিরুদ্ধে আমার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। ছেলেটাকেও আমার কাছে আনা হয়েছিল। মৌখিকভাবে সে জানিয়েছে যে তাকেও ইন্টার্নরা মারধর করেছেন। আমি তাকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছি। এ পর্যন্ত সেটা পাইনি।’
পরিচালক জানান, রিপন লিখিত অভিযোগ না দিলেও তিনি একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি করে দেবেন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সঙ্গে যে সুপারিশ আসবে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন।
হাসপাতালে থাকা অবস্থায় রিপন এ মারধরের ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি।
নগরীর রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল হক বলেন, ‘হাসপাতালে একটা ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি। কিন্তু আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। এটা হাসপাতালের ব্যাপার। তারপরও কোনো অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখা হবে।’