অব্যাহত বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। এটি উপকূল অতিক্রম করে বর্তমানে যশোর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড়টি উত্তর দিকে অগ্রসর ও দুর্বল হয়ে স্থল গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে।
সোমবার আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তি, ক্রমিক নম্বর-১৯ (উনিশ) -এ তথ্য জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
এতে বলা হয়েছে, প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল উত্তর দিকে অগ্রসর ও দুর্বল হয়ে স্থল গভীর নিম্নচাপ হিসাবে বর্তমানে যশোর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরো উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমশ বৃষ্টিপাত ঝরিয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হবে।
এদিকে আরো বলা হয়েছে, পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ১০ (দশ) নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ০৩ (তিন) পুনঃ ০৩ (তিন) নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৯ (নয়) নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ০৩ (তিন) পুনঃ ০৩ (তিন) নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে আগামীকাল সকাল (২৮ মে ২০২৪) পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে এবং সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
তলিয়ে গেছে সুন্দরবন
এদিকে বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে রোববার সকাল থেকে হালকা বৃষ্টিসহ দমকা বাতাস শুরু হয়। এর প্রভাবে সকাল থেকেই পানি বাড়তে শুরু করে সুন্দরবন।
সকাল ৮টা থেকে জোয়ার শুরু হয়ে দুপুর দুইটা পর্যন্ত জোয়ার হওয়ার কথা থাকলেও বিকেল ৫টা পর্যন্ত পানি বাড়তে শুরু করে।
দুপুরে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্র ও পর্যটন স্পটের ওসি আজাদ কবির জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ ফুট পানি বেড়ে সুন্দরবন তলিয়ে গেছে। পানির চাপ আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পুরো সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বন বিভাগের ঝুঁকিপূর্ণ ক্যাম্পগুলোতে থাকা বনরক্ষীদের এরই মধ্যে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে।’
সুন্দরবনের এই কর্মকর্তা জানান, করমজল বন্যপ্রাণী কেন্দ্রে এরই মধ্যে যেসব প্রাণী রয়েছে সেগুলো কিছুটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
এরই মধ্যে মোংলা বন্দরে পন্য ওঠানামা বন্ধ রেখেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। পণ্যবাহী ৬টি জাহাজকে রাখা হয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ে।
বাংলাদেশ-ভারতে রেমালের তাণ্ডব
এর আগে ঘূর্ণিঝড় রেমাল গতকাল রোববার রাত ৮টা নাগাদ সাগরদ্বীপ ও খেপুপাড়ার মধ্যে মংলার দক্ষিণ পশ্চিম দিক দিয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ে।
রেমালের ফলে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা-সহ বাংলাদেশের উপকূলের জেলাগুলোতে প্রবল গতিতে হাওয়া বইতে শুরু করে। তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছ্বাস হয়।
বরগুনার আমতলীতে জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে গেছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, রেমালের তাণ্ডবে বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বিভিন্ন জায়গায় প্রবল বষ্টি হচ্ছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বাড়ি থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে ৬৫ বছর বয়সী শওকাত মোড়ল নামের এক ব্যক্তি মারা যান। গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
এছাড়া জোয়ারের পানিতে ভেসে গিয়ে ২৪ বছর বয়সী শরীফুল ইসলাম নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধূলাসর ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় এই ঘটনা ঘটেছে।
বরগুনার তিনটি নদী বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে। পরশুনিয়ার বাঁধ ভেঙে গেছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বাঁধের উপর দিয়ে পানি বইছে। কক্সবাজারে জোয়ারের পানিতে অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
রাজধানী ঢাকায় সকালে দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টি হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা
পশ্চিমবঙ্গেও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বাঁধ ভেঙেছে। প্রবল জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। কলকাতায় রাতে ঝোড়ো বাতাস বয়েছে এবং প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। সোমবার সকালেও বিমান চলাচল বন্ধ ছিল। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখাতেও ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি।
রেমাল দুর্যোগে কলকাতায় ৫১ বছর বয়সী এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। সাজিব নামে ওই ব্যক্তির ছেলে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আইপিএল ফাইনাল দেখছিলেন। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হএয়ার পর তাকে বাড়িতে নিয়ে আসতে যান তিনি।
বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় এন্টালির বিবির বাগানে তিনি একটি বাড়ির নিচে আশ্রয় নেন। তখনই তার উপর বাড়ির কার্নিশ ভেঙে পড়ে ও তার মৃত্যু হয়।
সোমবার সকালে বৃষ্টি একটু কমলেও কলকাতার অনেক রাস্তায় পানি জমে আছে। কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, মোট ৫২টি গাছ পড়েছে। কয়েকটি রাস্তায় পানি জমে আছে। এখন বৃষ্টি কমলেও পরে আবার হতে পারে। ক্যামাক স্ট্রিটে একটি পাঁচিল ভেঙেছে।
কলকাতা থেকে ডিডাব্লিউর প্রতিনিধি গৌতম হোড় জানাচ্ছেন, রোববার বিকেল থেকেই কলকাতায় বৃষ্টি শুরু হয়। রাত যত বাড়ে ততই বৃষ্টির দাপট বাড়ে। শুরু হয় ঝোড়ো হাওয়া। রাত ১০টার পর থেকে ঝড় ও বৃষ্টি প্রবল হয়। গভীর রাত পর্যন্ত ঝড়-বৃষ্টির তাণ্ডব চলতে থাকে। সোমবার সকালেও আকাশ পুরো মেঘলা। ঝোড়ো হাওয়া থেমেছে। তবে মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে।
আবহাওয়া অফিস থেকে জানানো হয়েছে, এখন ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে রেমাল। তবে রেমালের প্রভাবে কলকাতায় ১৪৪ মিলিমিটার, ডায়মন্ড হারবারে ৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় রেলামের তাণ্ডব ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রবল বৃষ্টি ও ঝড় হয়। বিভিন্ন জায়গায় গাছ পড়েছে, বাড়ি ভেঙেছে।