অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, গ্লোবাল সাউথের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ ও শিক্ষার্থীদের অবশ্যই তাদের কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ তরুণ। এরা সমাজের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অংশ। তারা আলাদা। তারা একটি নতুন বিশ্ব গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
শনিবার তৃতীয় ‘ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিট’-এর উদ্বোধনী ‘লিডার্স সেশন’-এ ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
ক্ষুদ্রঋণের বাজার উন্নয়নে অবদানের জন্য ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, তরুণ ও শিক্ষার্থীরা সক্ষম এবং প্রযুক্তিগতভাবে তারা আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
তিনি বলেন, ‘তারা সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। তারা উদ্যোক্তা। তারা যে কাজ চায়, তা উপভোগ করার কারণে নয়, বরং অন্য কিছু পাওয়া যায় না। কারণ আমাদের সব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তাদের চাকরির জন্য প্রস্তুত করে।’
‘গরীব মানুষের ব্যাংকার’ হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তারা তাদের সৃজনশীল সক্ষমতা ভুলে গেছে।
ইউনূস বলেন, ‘তারপরও সব মানুষই সৃজনশীল জীব হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। তারা স্বভাবজাত উদ্যোক্তা। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে শুধুমাত্র চাকরিপ্রার্থী তৈরি ও তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য।’
তিনি বলেন, আমাদের ব্যবস্থাটি পুনরায় সাজাতে হবে। তিনি আশা করেন যে, তারা গ্লোবাল সাউথে একসাথে এটি করতে পারে। এটি দারুণভাবে সৃজনশীল তরুণ জনগোষ্ঠী সমৃদ্ধ।
সামাজিক ব্যবসার সাথে উদ্যোক্তা সমন্বয় অলৌকিক কিছু ঘটাতে পারে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে তরুণ জনগোষ্ঠীর সৃজনশীলতা ও শক্তিকে বিকাশে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে তিনি গ্লোবাল সাউথে কিছু সাধারণ সুযোগ-সুবিধার প্রস্তাব করতে চান।
এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ড. ইউনূসকে সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান।
অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে শপথ নেয়ার পর এটাই ছিল অধ্যাপক ইউনূসের প্রথম বহুপক্ষীয় বৈঠক।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঞ্চালনায় রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান পর্যায়ের উদ্বোধনী অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয়।
উদ্বোধনী নেতাদের অধিবেশনের প্রতিপাদ্য এবং সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘অ্যান এমপাওয়ারড গ্লোবাল সাউথ ফর এ সাসটেইনেবল ফিউচার।’
অধ্যাপক ইউনূস সকল পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলতে গ্লোবাল সাউথের নেতাদের একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান। বলেন, ‘আমরা যদি একসাথে কাজ করি, তবে এটি একটি বিশাল শক্তি হয়ে উঠতে পারে।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বুড়ো হওয়ার অর্থ এই নয় যে আপনাকে অবসর নিতে হবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হবে।’
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের নির্ধারিত মানুষের আয়ু অনুযায়ী সৃজনশীলতা কখনো থেমে থাকে না। ‘শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থামে না। আমরা একসাথে কাজ করে দেখতে পারি, কিভাবে সমাজকে সব মানুষের সৃজনশীলতার সহায়ক করে তোলা যায়, যতদিন তারা বেঁচে থাকবে।’
নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস বলেন, অর্থবহ সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বৈপ্লবিক পরিবর্তন, রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান পুনঃপ্রতিষ্ঠার তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুদলীয় গণতন্ত্রে রূপান্তর নিশ্চিত করতে এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এখন তাদের কাজ হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার, গণমাধ্যম, অর্থনীতি ও শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করা।
তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের শিগগিরই ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। অন্যথায় আপনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস করতে পারেন। ঢাকার বেশিরভাগ অংশ বিশ্বের গ্রাফিতির রাজধানীতে পরিণত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সী তরুণ শিক্ষার্থী এবং শিশুরা চার শ’ বছরের পুরনো এই শহরের দেয়ালে ‘নতুন গণতান্ত্রিক’ পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশের চিত্র দিয়ে রাঙিয়ে তুলছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এ জন্য কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বা দিকনির্দেশনা নেই। ‘কারো কাছ থেকে বাজেট সাপোর্ট পায়নি তারা। এটা দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্যের প্রতি তাদের আবেগ ও অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।’
তিনি বলেন, তারা তাদের জন্য রঙ এবং ব্রাশ কেনার জন্য দোকানে যান। তারা তাদের নিজস্ব বিষয় এবং নিজস্ব বার্তা তৈরি করে। ‘তারা যে বার্তাগুলো আঁকছে তা যে কাউকে শিহরিত করবে। তরুণরা কী স্বপ্ন দেখছে, তা যে কেউ তাদের মধ্যে পড়তে পারে। তাদের স্বপ্নকে সত্যি করাই আমাদের কাজ।’
তিনি ইতিহাসকে উদ্বৃত করে বলেন, ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশী ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল। এটি সারাবিশ্বে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছিল। প্রায় সাত দশক পরে আমাদের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় বিপ্লব গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মর্যাদা, সমতা এবং অংশীদারিত্বমূলক সমৃদ্ধির জন্য তাদের কণ্ঠস্বর উত্থাপন করতে গ্লোবাল সাউথ জুড়ে যুবকদের অনুপ্রাণিত করছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমি সবচেয়ে বয়স্ক ‘তরুণ’ হিসেবে এই বিপ্লবে অংশ নিতে পেরে এবং তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি। তাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদের সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করি।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস অউর সবকা প্রয়াস’ দর্শনের প্রচারে এই উদ্যোগটি শুরু হয়েছিল। আর এটি মূলত ভারতের বসুদেব কুটুম্বকমের দর্শন।
এটি গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অগ্রাধিকারগুলোকে একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক পরিসরে ভাগ করে নেয়ার পরিকল্পনার অংশ।
ভারত ২০২৩ সালের ১২ ও ১৩ জানুয়ারি প্রথম ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিট (ভিওজিএসএস) এবং একই বছরের ১৭ নভেম্বর দ্বিতীয় ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিটের আয়োজন করেছিল। তবে দু’টি সামিটই ভার্চুয়াল ফরম্যাটে আয়োজন করা হয়েছিল।
শীর্ষ সম্মেলনের পূর্ববর্তী উভয় আয়োজনে গ্লোবাল সাউথ থেকে এক শ’টিরও বেশি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল।