তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রতারণামূলক রায় ঘোষণার অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন হয়েছে।
আজ রবিবার ঢাকা সিএমএম আদালতে এ মামলার আবেদন করেন ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইমরুল হাসান। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথি বাদীর জবানবন্দি গ্রহণের পর আদেশ অপেক্ষমাণ রেখেছেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামি এবি এম খায়রুল হক বাংলাদেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি ছিলেন। বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে যোগ করা হয়েছিল। এরপর থেকে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়ে পরবর্তী সরকার গঠিত হচ্ছিল। ফলে আমরা দেখতে পাই যে, ১৯৯৬, : ২০০১ ও ২০০৮ সনের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অ্যাডভোকেট এম সলিম উল্লাহসহ কয়েকজনের রিট আবেদনে ২০০৪ সালে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ বলে ঘোষণা করে রায় দেন।
রায়ে বলা হয় যে, ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধান সম্মত ও বৈধ। এ সংশোধনী সংবিধানের কোনো মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নাই। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিট আবেদনকারী পক্ষই আপিল বিভাগে আপিল করেন। তবে এম সলিম উল্লাহ অসুস্থতার কারণে মারা যাওয়ায় আব্দুল মান্নান খান নামের আরেকজন আইনজীবী রিট আবেদনটি এগিয়ে নিয়ে যান।
২০১০ সালের ১ মার্চ আপিল বিভাগে এর শুনানি শুরু হয়। আপিল আবেদনকারী এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছাড়াও শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে শীর্ষস্থানীয় আটজন আইনজীবী বক্তব্য দিয়েছেন। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সিনিয়র আইনজীবী টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। বিভক্ত বাংলাদেশি সমাজের শীর্ষ সব আইনজীবী একটি প্রশ্নে একমত পোষণ করলেন। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা বহাল রাখার পরামর্শ দিলেন তারা। এমনকি শুনানির সময় প্রয়াত সিনিয়র আইনজীবী টিএইচ খান চরম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হলে দেশে বিপর্যয় তৈরি হবে, গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে। অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য অভিযুক্ত আমলে না নিয়ে তার চাকরিকালের শেষ দিকে আপিল বিভাগের ৭ জন বিচারপতির সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ হলে পর ৬ জন বিচারপতির মধ্যে ৩ জন বিচারপতি অ্যামিকাস কিউরিদের সঙ্গে একমত হন এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী কোনো সংকট তৈরি করেনি বলে মত দেন কিন্তু অপর ৩ জন বিচারপতি ভিন্ন মত তুলে ধরলে মামলার ফলাফল টাই হয়। ফলে প্রধান বিচারপতি হিসেবে এ বি এম খায়রুল হকের হাতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল এবং তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন এবং বিগত ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় প্রদান করেন।
ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় প্রকাশ্যে আদালতে ঘোষিত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পথ খোলা রেখেছিল। কিন্তু রায়ের ব্যাপারে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ জনমনে অসন্তুষ্টি দেখা দেওয়ায় তিনি আর স্বাক্ষর প্রদান করেন নাই এবং নথি নিজ জিম্মায় বাসায় নিয়ে রাখেন। ২০১২ সালের ১৭ মে অবসর গ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে তিনি আপিল মামলার নথি বাসায় নিয়ে যান, যা বেআইনি। এই বিষয়ে ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা বাংলাদেশ সংবিধান, আইনের রক্ষণ, সমর্থক ও নিরাপত্তা বিধানের মত গ্রহণ করেন। কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তার গৃহীত শপথ ও বহাল থাকে না। আদালতের নথির সরকারি দলিল। কোনো কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী।
এরপর বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচন সময় এগিয়ে আসলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগকে চিরকাল ক্ষমতায় রাখার জন্য ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পূর্নাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় প্রকাশ্যে আদালতে ঘোষিত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পথ খোলা রেখেছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ১৬ মাস ৩ দিন পর যে রায় প্রকাশ করলেন সেখানে তিনি এ অংশটি রাখেননি। আপিল বিভাগের দুইজন বিচারপতি এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। দৃশ্যত আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তই অনুসরণ করেছিলেন খায়রুল হক। বিচারপতি খায়রুল হকের এ রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল তিনি। যদিও বিচারপতি খায়রুল হকের নাম মুখে নেননি।
বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বলেছিলেন, পদ্ধতিগত কারণে আপিল বিভাগের রায়ে দেরি হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে সেটা যৌক্তিক সময়, যেমন এক মাসের মধ্যে হতে পারে। কিছুতেই এক-দেড় বছর হতে পারে না। আর অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদেশের অংশ কোনোভাবেই পরিবর্তন করা যাবে না। সেটা করতে গেলে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন ও শুনানি হতে হবে। কিন্তু তা না করেই যদি রাতের অন্ধকারে, এক-দেড় বছর পর রায় পরিবর্তন করে ফেলেন, তাহলে সেটা ফৌজদারি অপরাধ। মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি মানবজমিন এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রায়ে এ ধরনের পরিবর্তন ফৌজদারি অপরাধ।
মামলায় বলা হয়, বিচারকদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের মূল হলো আস্থা ও বিশ্বাস। অভিযুক্ত প্রধান বিচারপতির পদে আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হয়ে সেই পদকে ইচ্ছামত নিজের পছন্দের দলকে চিরকালের জন্য ক্ষমতায় বসিয়ে রাখার জন্য নির্বাচনহীন একটি প্রহসনের দেশ তৈরি করার জন্য অসাধুভাবে প্রধান বিচারপতির পদ ব্যবহার করে ঘোষিত রায় পরিবর্তন করা ফৌজদারি অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ এবং পুরো জাতির সাথে প্রতারণা বিধায় দণ্ডবিধি আইনের ৪২০/৪০৬ ধারায় অপরাধ করে বাংলাদেশের জনগণের ক্ষতি বা অনিষ্ট করার জন্য প্রকাশিত রায় আইনি পন্থা ব্যাতিরেকে অর্থাৎ কোন রিভিউ পিটিশন ছাড়াই অত্র রায় এর অংশবিশেষ বাতিল করে ১৬ মাস ৩ দিন পর চাকরি না থাকা অবস্থায় স্বাক্ষর করত রায় প্রচার করায় ৪৬৭/৪৬৮ ধারায় অপরাধ করেছেন।