আইন ও আদালত

ছাত্রশিবিরের ৬ কর্মীকে গুম : ট্রাইব্যুনালে র‌্যাব-ডিবির বিরুদ্ধে অভিযোগ

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছয় কর্মীকে গুমের অভিযোগে র‌্যাব ও ডিবির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেছে তাদের পরিবার।

সোমবার (২১ অক্টোবর) ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে এ অভিযোগ দাখিল করা হয়।

২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে গুম হওয়া ইসলামী ছাত্রশিবিরের এই ছয়জন নেতাকর্মী হলেন- শাহ মো: ওয়ালিউল্লাহ, মো: মোকাদ্দেস আলী, হাফেজ জাকির হোসেন, মো: জয়নাল আবেদীন, রেজোয়ান হোসাইন ও মু. কামরুজ্জামান।

ছয় কর্মীকে গুমের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করার সাংবাদিকদের সাথে কথা কথা বলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় ছাত্রকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন, আইন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও সহকারী আইন সম্পাদক আমানুল্লাহ আদিব এবং গুম হওয়া ছাত্রশিবির নেতাদের পরিবারের সদস্যরা।

এ সময় জানানো হয়, গুম হওয়ার পর দীর্ঘ সময় পার হলেও ইসলামী ছাত্রশিবির ও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি ও মানবাধিকার সংস্থায় অভিযোগ করে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

গুমের অভিযোগ দাখিল করার পর ট্রাইব্যুনালে এক ব্রিফিংয়ে তারা বলেন, ‘গত ১৭ বছর ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার। জেল-জুলুম, মামলা-হামলা, রিমান্ড, হত্যাসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন এখনো গুম আছেন। ওই ছয়জনকে খুঁজতে ৬ আগস্ট র‌্যাব সদর দফতরে গিয়েছিল পরিবারের সদস্যরা। কর্তৃপক্ষ তাদের সহযোগিতা করবে বলে জানালেও এখনো কোনো তথ্য দিতে পারেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গুম হওয়া ছয় নেতাকর্মীর সন্ধান ও র‌্যাব-ডিবির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছে তাদের পরিবার। আমরা ভিকটিমের পরিবারের সাথে এসেছি। এবং তাদেরকে এই অভিযোগ দায়ের করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছি।’

তারা বলেন, ‘আমরা এখানে কাউকে আসামি করেনি। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথা বলেছি। আমরা অভিযোগ করেছি, ট্রাইব্যুনাল তদন্ত করে সত্যিকারের যারা অপরাধের সাথে জড়িত। যারা এই গুমের সাথে জড়িত তাদের বের করবে এবং শাস্তির আওতায় আনবে বলে মনে করি। এখানে আমরা র‌্যাব ও ডিবির কথা বলেছি।’

গুমের শিকার শিবিরকর্মী রিজওয়ান হোসেনের ভাই রিপন হোসেন জানান, ‘২০১৬ সালের ৪ আগস্টে আমার ভাইকে সবার সামনেই বাইকে করে তুলে নিয়ে যান এসআই নূর আলম ও তার একজন লোক। আমরা তৎক্ষণাৎ থানায় গেলে ওসি অপূর্ব হাসান আমাদের বলে ওকে (রিজওয়ানকে) খুঁজতে নিষেধ করেন। আমাদের পরিবারসহ গুম করে ফেলারও হুমকি দেন। পরে আমাদের কোনো মামলা নেয়নি, উলটো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। একদিন জানালেন আমার ভাই তুরস্কে গিয়েছে আইএসে যোগ দিতে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই লেখাপড়া করিনি, কষ্ট করে ওকে পড়ালেখা করিয়েছি। আমার ভাইয়ের সন্ধান চাই আমরা। আমরা চাই আমাদের ভাইকে ফেরত দেয়া হোক। আমরা এই ছোট ভাইয়ের কারণে আমরা মা পাগল হয়ে গেছেন।’

এসময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বলেন, ‘আমরা উপদেষ্টাদের কাছে এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’

গুম হওয়া আরেক শিবিরকর্মী শাহ মো: ওয়ালিউল্লাহর বোনের জামাই জানান, ‘২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার কল্যাণপুর থেকে হানিফ বাসে করে কুষ্টিয়া যাচ্ছিলেন ওয়ালি আর মোকাদ্দেস আলী। সাভার নবীনগর এলাকায় বাস থামিয়ে র‌্যাব পরিচয়ে ওয়ালিকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে থানা আর র‌্যাব সদর দফতরে আমরা অনেক যোগাযোগ করেছি। তারা আমাদের কোনো তথ্যই দিতে পারেনি। তাদেরকে যেন আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয় সেই আবেদন করছি। ওয়ালিউল্লাহকে ফিরিয়ে আনতে যে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন ট্রাইব্যুনাল সেই পদক্ষেপ নেবে বলে আমরা আশা করছি।’

সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, ২০১৩ সালের ২ এপ্রিল দিবাগত রাত ৪টায় সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শ্যামলী রিং রোডের ১৯/৬ টিক্কাপাড়া বাসা থেকে হাফেজ জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও তার কোনো সন্ধান দেয়নি পুলিশ।

একইভাবে ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট দুপুর ১২টায় বেনাপোল পোর্টসংলগ্ন দুর্গাপুর বাজার থেকে বেনাপোল পোর্ট থানার এসআই নূর আলমের উপস্থিতিতে দোকান মালিক, কর্মচারীসহ অসংখ্য মানুষের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয় ছাত্রশিবির নেতা রেজোয়ান হোসাইনকে। আট বছর পেরিয়ে গেছে; কিন্তু আজও তার কোনো সন্ধান দেয়নি পুলিশ।

২০১৭ সালের ১৮ জুন বান্দরবান সদরের শহরতলির লেমুঝিরি গর্জনিয়াপাড়া মসজিদের কক্ষ থেকে ছাত্রশিবিরের নেতা মো: জয়নাল আবেদীনকে গুম করা হয়। পরের বছরের (২০১৭) ৭ এপ্রিল ঝিনাইদহের সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসার মেধাবী ছাত্রশিবিরের কর্মী মু. কামরুজ্জামানকে ঝিনাইদহ সদরের লেবুতলা থেকে ডিবি পরিচয়ে নিয়ে যায়। সংগঠন ও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের সন্ধানে বিভিন্ন সরকারি ও মানবাধিকার সংস্থায় অভিযোগ জানিয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি।