বৈশ্বিক জ্বালানি শক্তির চাহিদা গত কয়েক দশকে তীব্রভাবে বেড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এর প্রধান কারণ। কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল জ্বালিয়ে আমরা বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করছি। এগুলোর পরিমাণ সীমিত। শক্তির নতুন উৎস খুঁজে না পেলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে এই সম্পদগুলো শেষ হয়ে যাবে। এই সমস্যা মোকাবিলায় উন্নত বিশ্বের দেশগুলো নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকছে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার ১০০ ভাগ করার লক্ষ্যে কাজ করছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য শুধু কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেলের মজুতের উপর নির্ভর করে থাকলে চলবেনা। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে এখনই আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) এর ‘এনার্জি আর্কিটেকচার পারফরম্যান্স ইনডেক্স-২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যুতের কাঠামোগত দক্ষতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ১২৭টি দেশের মধ্যে ১০৪তম। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এর হিসাব মতে, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ) ২৫,৫৬৬ মেগাওয়াট। মাথাপিছু উৎপাদন ৫৬০ কিলোওয়াট প্রতি ঘন্টা। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১৫২টি। এই সকল বিদ্যুতকেন্দ্রের কর্মদক্ষতা কম হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে অপচয় হয় প্রচুর পরিমাণ জ্বালানির, সেইসঙ্গে পরিবেশে অতিরিক্ত কার্বন অবমুক্ত হয়। বিশ্বব্যাংকের ২০১৫ সালের গ্লোবাল কার্বন অ্যাটলাস শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছর বাংলাদেশের নিঃসরণ করা কার্বনের পরিমাণ ছিল ৭৭ মেট্রিক মেগাটন। ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৩ মেট্রিক মেগাটনে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি মালিকানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ছিল ৮৭টি; যার মধ্যে প্রায় ৮২টি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে।
শক্তির ব্যবহার ও সরবরাহ সম্পর্কিত সমস্যাগুলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, বায়ু ও পানি দুষণ, বনাঞ্চল নিধন, ওজোনস্তর ক্ষয়, এসিড বৃষ্টি, গ্রিনহাউজ গ্যাস, বন্যপ্রাণী নিধন ইত্যাদির সাথে সম্পর্কিত। এসব সমস্যার একটি কার্যকরী সমাধান হতে পারে নবায়নযোগ্য শক্তি। জীবাশ্ম ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির পার্থক্য হল উৎসের নবায়নযোগ্যতা। জীবাশ্ম জ্বালানি নবায়নযোগ্য নয়। সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ু প্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈব শক্তি, ভূ-তাপ, সমুদ্র তরঙ্গ, সমুদ্র-তাপ, জোয়ার-ভাটা, শহুরে আবর্জনা, হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ইত্যাদি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস।
নদীমাতৃক এদেশে জলবিদ্যুৎ, বিস্তৃত ভূমিতে বায়ুশক্তি ও সৌরশক্তি, বায়োমাস, বায়োফুয়েল, জিওথার্মাল, সমুদ্রের ঢেউ ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়াজনিত কারণ বিবেচনায় সোলার প্যানেল সিস্টেম সূর্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনাও এদেশে অপরিসীম। এই অপরিসীম সম্ভাবনা নিয়ে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালে ময়মনসিংহে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সুতিয়াখালী সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়; ২০২০ সাল থেকে যা জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছে। এছাড়া সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর অধিকাংশ জাতীয় গ্রিডের সাথে সংযুক্ত না হলেও গ্রিডের উপর চাপ কমাতে সাহায্য করছে। দ্বীপ, বিভিন্ন চরাঞ্চল ও পার্বত্য অঞ্চল যেখানে মানুষের কাছে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পৌছানো সম্ভব হয়নি, সেখানে শতভাগ সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে দৈনন্দিন জীবনের কাজ করা হচ্ছে। সোলার পাম্প সেচ ব্যবস্থায় এনেছে বিপ্লব। ইতিমধ্যে দেশে প্রায় ৪ লক্ষ ইজিবাইক সৌর বিদ্যুতে চালিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার: যা শুধু জাতীয় গ্রিডের উপর চাপই কমাবে না; বরং, পরিবেশবান্ধব এই বাহনের চাহিদা এবং এখাতে কর্মসংস্থানও বাড়াবে।
আবার বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনাও আমাদের দেশে ব্যাপক। ফেনীর সোনাগাজী ও কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ায় বায়ুর গতিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে উইন্ড ম্যাপ বা বাতাসের গতিবিধি পর্যালোচনা করে বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনে সম্ভাবনাপূর্ণ ৯টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
বায়োগ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনেরও উর্বর ভূমি বাংলাদেশ। জৈব সার, পৌর বর্জ্য, নর্দমার আবর্জনা, খাদ্যবর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস উৎপন্ন হয়। এই গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ থাকলেও তা এখনও সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানো যায়নি। বায়োগ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রতি জেলায় ১ হাজার করে মোট ৬৪ হাজার বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করার মাধ্যমে রান্নার জ্বালানি সংকট নিরসন ও পরিবেশ দূষণ কমানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়নোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এ প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা দিয়ে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামীণ যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর ঝুঁকিহ্রাস সংক্রান্ত বিষয়াদি বিবেচনায় এনে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন ও উন্নয়ন নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২০০৮ সালে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি কার্যকর করা হয়। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (SREDA) ২০১২ সালে ¯্রডো অ্যাক্ট প্রণয়ন করে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োমাস, বায়োফুয়েল, জিওথার্মাল, নদীর ¯্রােত, সমুদ্রের ঢেউ ইত্যাদি শনাক্ত করা হয়। এই কার্যক্রমের আওতায় সরকার ২০২০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎখাতে ব্যবহৃত জ্বালানির ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এ কাজে অগ্রগতি আনতে সারাদেশে ৬০ লাখ হোম সোলার সিস্টেম, ২,২২৫ টি সোলার ইরিগেশন সিস্টেম ও ২৭টি মিনি গ্রিড স্থাপন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ১০,০০০ সোলার বিতরণ করা হয়।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল বিশ্বের সদস্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তাই সরকার দেশের শহর এবং গ্রামের জীবনমানের বৈষম্য দূর করতে বদ্ধপরিকর। গ্রামীন জনপদে বিদ্যুতের উন্নয়ন, নিশ্চয়তা এবং সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব পরিকাঠামো গড়ে তোলা বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। নবায়নযোগ্য শক্তি সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে জ্বালানি সংরক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু করতে হবে। নবায়যোগ্য শক্তি সংরক্ষণ ও প্রয়োগের বিষয়ে বাস্তবসম্মত জ্ঞান খুব প্রয়োজন। তা হলেই আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুশোভিত ও নিরাপদ পৃথিবী উপহার দিতে পারব।
রাফিদ আল তাহমিদ
আলোকচিত্র গ্রাহক
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী