দেশে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যাদের ৫ শতাংশই শিশু। সে হিসাবে বর্তমানে ২৫ লাখ শিশু ডায়াবেটিসে ভুগছে। গত এক দশকে শিশুদের ডায়াবেটিসের হার উদ্বেগজনক বাড়ছে বলে দাবি করেছেন একাধিক বিশেষজ্ঞ। তাঁরা বলছেন, দেশে শিশুদের টাইপ-১ ডায়াবেটিসের প্রকোপ অনেক কম। তবে বড়দের মধ্যে দেখা যাওয়া টাইপ-২ ডায়াবেটিসে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। টাইপ-১ ডায়াবেটিস জন্ম ও পরিবেশগত বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। এতে এক ধরনের ইমিউন সিস্টেম জটিলতায় দেহের অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলো দ্রুত ধ্বংস হয়ে ইনসুলিন উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে বাকি জীবন তাকে ইনসুলিনের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতে হয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কারণে রক্তে শর্করার আধিক্যে ভুগে হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা, অন্ধত্ব বা পা হারানোর মতো জটিলতার আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। মূলত যেসব শিশুর ওজন বেশি, অতিমাত্রায় শরীরে মেদ, কায়িক পরিশ্রম কম; তাদের এ রোগ বেশি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত নগরায়ণ, জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, প্রাত্যহিক পরিশ্রমের অভাব এবং অতিমাত্রায় মোবাইল ফোনে আসক্তির কারণে শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিসের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এটি কমাতে বাচ্চাদের খেলাধুলা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, দৌড়ঝাঁপ ছাড়াও দাঁত ও মুখের যত্ন নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। এমনকি রোগটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সময়মতো চিকিৎসা নিতেও বলছেন চিকিৎসকরা।
এমন পরিস্থিতিতে আজ সোমবার নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় ডায়াবেটিস শিক্ষা’। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয়, সচেতনতামূলক পোস্টার, লিফলেট বিতরণ, প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান কর্মসূচি, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, চিকিৎসক-রোগীদের আলোচনা-প্রশ্নোত্তর পর্ব ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের পাশাপাশি সবার জন্য সেবা নিশ্চিত করতে পারলে এটি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য দেশের তৃণমূল পর্যায়ে সেবা পৌঁছানোর কথা বলছেন তাঁরা। একই সঙ্গে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ডিজিটাল ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগকে আরও শক্তিশালী করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।
বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফারুক পাঠান বলেন, কয়েক বছর ধরে শিশুদের ডায়াবেটিসের হার বেড়েছে। করোনা দুই বছর এই হার আরও বাড়িয়েছে। আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, আগের চেয়ে শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, ‘টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তাঁরা ডাক্তারের কাছে আসেন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পাঁচ-ছয় বছর পর। এ দেশের মানুষের আয়ুস্কাল ৭৩ বছর হলেও ডায়াবেটিস রোগীর আয়ুস্কাল ৬৩ বছর। শুধু ডায়াবেটিস থাকার কারণেই জীবন থেকে তাঁদের ১০ বছর নেই হয়ে যায়। এই ১০ বছর তাঁরা পরিবার, সমাজ ও দেশকে দিতে পারতেন।
বারডেমের ‘চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন প্রোগ্রামে’র (সিডিআইসি) সমন্বয়কারী ডা. বেদোয়ারা জেবিন বলেন, সারাদেশে ১৮ বছরের নিচে সাত হাজারের বেশি শিশু নিবন্ধন করেছে। এরা টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ভুগছে। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ধারণা, প্রকৃত সংখ্যা হয়তো এর দ্বিগুণ।
ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, ‘দেশে ১ কোটি ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী। এর মধ্যে ৫ শতাংশ শিশু জুভেনাইল বা টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। শিশুদের শরীরে ইনসুলিনের অভাবে এই রোগ দেখা দেয়। ইনসুলিন ছাড়া এসব শিশু বাঁচে না। তবে আক্রান্ত এসব শিশুর বেশির ভাগই সচেতনতার অভাবে ইনসুলিন পাচ্ছে না। আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণেও অনেক মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের ইনসুলিন দিতে পারছেন না। তবে তাদের জন্য বিনামূল্যে ইনসুলিন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্য বলছে, ডায়াবেটিস চিকিৎসায় মাত্র ৩০০ জন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট (ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞ) রয়েছেন। এ হিসাবে প্রতি ৬৬ হাজার রোগীর সেবায় চিকিৎসক মাত্র একজন। আর মোট জনসংখ্যার হিসাবে প্রতি ১২ লাখ মানুষের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের প্রধান ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ বলেন, গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা পরিবর্তন হয়েছে। শহরের মানুষের সঙ্গে তাদের মধ্যেও কায়িক পরিশ্রমের হার প্রতিনিয়ত কমছে। আগে প্যাডেলের মাধ্যমে রিকশা-ভ্যান চললেও সেগুলো এখন অটো হয়েছে। এতে উদ্বেগজনক হারে গ্রামেও সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে।
২০১৮ সালে দেশের সব উপজেলায় ডায়াবেটিস নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখানে দেখা যায়, শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে আক্রান্তে পার্থক্য খুব বেশি নয়। শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও বড় পার্থক্য দেখা যায়নি। যাঁদের মধ্যে ধূমপান, অস্ব্বাভাবিক জীবনযাপন ও শারীরিক পরিশ্রমের হার কম; তাঁদের ডায়াবেটিসে ভোগার হার অন্যদের থেকে কিছুটা বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (এনসিডিসি) জানিয়েছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৫০ ভাগেরই কোনো লক্ষণ থাকে না। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে চল্লিশোর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর ডায়াবেটিস পরীক্ষার জন্য দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ব্যবস্থা রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বর্তমানে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে ডায়াবেটিস মাপার যন্ত্র আছে। ডায়াবেটিসসহ সব অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এনসিডিসি কর্নার স্থাপনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ২০০টি হাসপাতালে চালু হয়েছে। এ ছাড়া আটটি মেডিকেল কলেজে এন্ডোক্রানোলজি বিভাগ তৈরি হয়েছে।
দিবসে নানা কর্মসূচি: ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবারের মতো এবারও বাডাস নানা কর্মসূচি নিয়েছে। দেশব্যাপী সচেতনতামূলক পোস্টার, লিফলেট বিতরণ করা হবে। আজ সকাল সাড়ে ৮টায় শাহবাগ বারডেম থেকে রমনা পার্কের গেট পর্যন্ত রোড শো অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ১০টায় বারডেম অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও রোগীদের আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্ব। বিকেল ৩টায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের উপস্থিতিতে হবে আলোচনা সভা। অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত রমনা পার্কের গেট ও ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরসহ বিআইএইচএস ও এনএইচএনের আওতাধীন বিভিন্ন কেন্দ্রে বিনামূল্যে ডায়াবেটিস নির্ণয় ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি। ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে হ্রাসকৃত মূল্যে দিনব্যাপী হার্ট ক্যাম্প হবে। ১৮ নভেম্বর সকালে চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়েছে।