জাতীয়

চট্টগ্রামে বিধ্বস্ত ইয়াক-১৩০ বিমান সম্পর্কে যা জানা গেছে, আগেও ঘটেছিল দুর্ঘটনা

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী জানিয়েছে তাদের একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধ বিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় দুর্ঘটনায় পড়েছে এবং এ ঘটনায় একজন পাইলটের মৃত্যু হয়েছে। একই মডেলের আরেকটি বিমান ২০১৭ সালেও চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় বিধ্বস্ত হয়েছিল।

বৃহস্পতিবার (৯ মে) সকালে উড্ডয়নরত অবস্থায় আগুন লাগার পর দুজন পাইলট প্যারাসুট দিয়ে নেমে এসেছিলেন। পরে কর্ণফুলী নদী থেকে তাদের উদ্ধার করে বিএনএস পতেঙ্গা হাসপাতালে নেয়া হয়।

দুপুর ১২টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই মারা যান দুই পাইলটের একজন স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ। অপর পাইলট উইং কমান্ডার সুহান জহুরুল হক চিকিৎসাধীন আছেন।

ঢাকায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) বিমান বাহিনী ডেস্ক বিবিসি বাংলার কাছে ‘ওয়াইএকে ১৩০’ মডেলের প্রশিক্ষণ বিমানটির দুর্ঘটনায় পড়ার খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।

এদিকে, আকাশে উড্ডয়নরত থাকা অবস্থায় প্রশিক্ষণ বিমানটিতে আগুন লাগার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে বিমানটিতে আগুন লেগে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে।

এরপরপরই আগুন লেগে যেতে দেখা যায় বিমানটিতে। তখনি পাইলটরা প্যারাসুট বেয়ে নিচে কর্ণফুলী নদীতে পড়েন।

চট্টগ্রামের পুলিশ জানিয়েছে, বিমানবাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে ওড়ার পর বিমানটি দুর্ঘটনার শিকার হয়।

নদীতে বিধ্বস্ত হওয়া বিমান উদ্ধারে কাজ করে নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার পতেঙ্গায় যে মডেলের বিমান দুর্ঘটনায় পতিত হলো ঠিক একই মডেলের আরেকটি বিমান ২০১৭ সালের জুলাইতে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল, তবে সেবার পাইলটরা নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন।

আইএসপিআর যা বলেছে
আইএসপিআরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে বিমান বাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক থেকে উড্ডয়নের পর প্রশিক্ষণ শেষে ফেরার সময় কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে দুর্ঘটনায় পতিত হয়।

দুর্ঘটনার পর দুই বৈমানিক জরুরি প্যারাসুট দিয়ে নদীতে অবতরণ করেন। তাদের বিমান ও নৌবাহিনীর উদ্ধারকারী দল ও স্থানীয় জেলেদের প্রচেষ্টায় উদ্ধার করা হয়।

এর মধ্যে স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় বিএনএস পতেঙ্গায় নেয়া হয়। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

‘বিমানটিতে আগুন ধরে যাওয়ার পর বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে বৈমানিকদ্বয় অত্যন্ত সাহসিকতা ও দক্ষতার সাথে বিমানটিকে বিমানবন্দরের কাছে অবস্থিত ঘনবসিতপূর্ণ এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যেতে সক্ষম হন,’ বলা হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে।

২০১৭ সালেও একই মডেলের একটি বিমান বিধ্বস্ত
২০১৭ সালের জুলাইয়ে চট্টগ্রামের লোহাগড়ার বড় হাতিয়ার ফরিদারঘোনায় বিধ্বস্ত হয়েছিল ওয়াইএকে-১৩০ মডেলের আরেকটি প্রশিক্ষণ বিমান।

জহুরুল হক বিমান ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর স্থানীয় একটি লিচু বাগানের কাছে বিধ্বস্ত হলেও সেবার দুই পাইলট নিরাপদে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ইয়াক-১৩০ বিমান সম্পর্কে যা জানা গেছে
রাশিয়ায় তৈরি এ কমব্যাট প্রশিক্ষণ বিমানটির মূল নাম দ্যা ইয়াকভলেভ ইয়াক-১৩০, যা সংক্ষেপে ওয়াইএকে বা ইয়াক-১৩০ নামে পরিচিত।

দুই আসনের এই বিমানটি মূলত উচ্চতর প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত হলেও যুদ্ধেও এটি হালকা মাত্রায় ব্যবহারের উপযোগী। বিশেষ করে স্বল্প মাত্রার আক্রমণে ব্যবহারের জন্যও এটাকে কাজে লাগানো যায়।

ইয়াক ১৩০টির মানোন্নয়ন করে রাশিয়া ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে এর প্রথম ফ্লাইট পরিচালনা করেছিল। পরে ২০১০ সালে রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে সংযুক্ত হয় দুই ইঞ্জিনের এই বিমানটি।

রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম স্পুটনিকের খবর অনুযায়ী, ২০১৪ সালে রাশিয়ান ঋণ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ২৪টি এ ধরনের প্রশিক্ষণ বিমানের অর্ডার দেয় রাশিয়াকে, যার আনুমানিক মূল্য তখনকার সময়ে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার ছিল।

পরে অবশ্য অর্ডার কমিয়ে ১৬টি করা হয় বলে জানা গেছে।

ওই খবর অনুযায়ী, প্রশিক্ষণ বিমানে ইংরেজি ভাষাভিত্তিক ককপিট করে পরের বছরেই বাংলাদেশকে সরবরাহ শুরু করার কথা।

অর্থাৎ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে মূলত ২০১৫ সাল থেকে এই মডেলের প্রশিক্ষণ বিমান সংযুক্ত হয়। ওই বছর প্রথম ব্যাচে ছয়টি ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশকে হস্তান্তর করে রাশিয়া।

২০১৬ সাল নাগাদ ক্রয়াদেশ দেয়া সব ওয়াইএকে-১৩০ বিমান বাংলাদেশকে সরবরাহ করা সম্পন্ন করে রাশিয়া।

স্পুটনিকের তথ্য অনুযায়ী, হালকা ওজনের এই বিমানটি রাশিয়ার এডভান্সড মডেলের একটি ফাইটার।

একই সাথে এ বিমানটিকে স্থলভাগে হামলায় কিংবা আকাশ থেকে আকাশে উৎপক্ষেপণযোগ্য অস্ত্র বহনে ব্যবহার করা যায়।

এর আগে ১৯৯৯ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে আটটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান কিনেছিল তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার। পরে এ নিয়ে ২০০১ সালের শেষ দিকে শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। যদিও মামলাটি পরে ২০১০ সালে হাইকোর্ট বাতিল করে দেয়।

২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসার ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার রাশিয়া থেকে রাষ্ট্রীয় ঋণে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার সমরাস্ত্র ক্রয় করেছিল।

সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর জন্য এসব যুদ্ধ সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া দ্রুততর করা হয়েছে মূলত ফোর্সেস গোল-২০৩০ কর্মসূচি গ্রহণের পর।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতার আসার পর এ কর্মসূচিটি প্রণয়ন করা হয়েছিল।

মূলত বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নৌবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে নতুন করে ফোর্সেস গোল প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। পরে ২০১৭ সালে এটিকে কিছুটা পরিমার্জনও করা হয়েছে।

সূত্র : বিবিসি